ইসলামে বাচ্চা বা শিশু প্রহারের নীতি; তবে রাসুল (স) কোনো শিশুকে প্রহার করেন নি

 

রাসুল (স) কখনো কোনো বাচ্চা বা শিশুকে প্রহার করেননি; তবে প্রয়োজনে প্রহারের নীতি জানিয়ে দিয়েছেন

ইদানিং দেখা যাচ্ছে, বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিশু বাচ্চাদের শাসনের জন্য প্রহারের/ মারের/ ছাত্র পিটানোর ঘটনা প্রায়ই ভাইরাল হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে পিছিয়ে থাকেনি আমাদের ইসলামিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান: মক্তব, হেফজ খানা, কওমি মাদ্রাসা, সাধারণ মাদ্রাসা বরং কিছুটা অগ্রগামী বললেও অত্যুক্তি হবে না। কিন্তু কেন এমন হবে ইসলামিক প্রতিষ্ঠানে? কারণ তাঁদের আদর্শ তো জগৎ সমূহের শ্রেষ্ঠ মানব হযরত মুহাম্মাদ (স), তাঁরা তো মুখে বলেন, হযরত মুহাম্মাদ (স) ও তাঁর আদর্শ তাদের প্রাণের চেয়ে প্রিয়। তাহলে আসুন এখন আমরা দেখি সেই প্রিয় নবি (স) এর শিশু বাচ্চাদের শাসনের জন্য প্রহারের/ মারের/ ছাত্র পিটানোর ক্ষেত্রে কী করেছেন?

আবু উমামা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে একবার দুটি বালককে আনা হলো। একজনকে তিনি আলি রাদিয়াল্লাহু আনহুর হাতে অর্পণ করলেন এবং বললেন: لا  تضربه فاني نهيت عن ضرب أهل الصلاة، وإني رأيته يصلي منذ أقبلنا
"একে প্রহার করবে না। কোনো সালাত আদায়কারীকে প্রহার করতে আমাকে নিষেধ করা হয়েছে। আর আমি দেখছি, আসার পর থেকে সে সালাত আদায় করছে ।..." দলিল: সহিহ আল আদাবুল মুফরাদ লিল আলবানি:১২১

প্রহারের/ মারের/ ছাত্র পিটানোর উদ্দেশ্য রাগ মেটানো নয়; সংশোধন ও শিক্ষাদান

ইসলামের সন্তান প্রতিপালনের ক্ষেত্রে তাকে প্রহার করতে হলে সেটার উদ্দেশ্য থাকে সংশোধন এবং শিক্ষাদান। প্রতিশোধ গ্রহণ বা রাগ মেটানো নয়। সুতরাং শিশুকে শাস্তি দেওয়ার আগে তার স্বভাব ও মনোভাব বোঝা কর্তব্য। প্রথমে তাকে নিজের কৃত ভুলটি বুঝিয়ে দিতে হবে। এতে যদি সে সংশোধন করে নেয় তাহলে তাকে অবশ্যই মাফ করে দিতে হবে।

প্রহারের ক্ষতি: (এক) কঠোর আচরণ শিশুকে কঠোর করে তোলে

ইবনু খালদুন রহিমাহুল্লাহ তাঁর মুকাদ্দিমায় উল্লেখ করেছেন, "শিশু, শিক্ষার্থী, দাস বা খাদেমের প্রতিপালনের ক্ষেত্রে তাদের সাথে শক্ত ও কঠিন আচরণ করা হলে তাদের নিজস্ব আচরণেও কঠোরতা তৈরি হতে শুরু করে। তাদের ওপর কঠোরতা করার কারণে তাদের মন সংকুচিত হয়ে পড়ে। উদ্যম হারিয়ে যায়। ফলে অলসতা জেঁকে বসে তাদের মনন-মানসে। 

প্রহারের ক্ষতি: (দুই) মিথ্যা বলায় অভ্যস্ত হয়ে উঠে

কঠোরতার হাত থেকে বাঁচতে তারা মিথ্যা ও ধোঁকার আশ্রয় নিতে থাকে। ফলে ধীরে ধীরে মিথ্যা বলা তাদের স্বভাবে পরিণত হয়। মনুষ্যত্ব তাদের থেকে লোপ পেতে থাকে।"

প্রহারের ক্ষতি: (তিন) সম্মানে আঘাত পাওয়ায় নির্লজ্জ হয়ে ওঠে

শাস্তির ক্ষেত্রে লক্ষ রাখতে হবে, শাস্তিটা যেন তার সম্মানে আঘাত না করে। এর কারনে সে অপমানিত না হয়। যেমন: মানুষের সামনে তাকে প্রহার করা, অথবা মানুষকে তার অপরাধ জানিয়ে দেওয়া। সে চুরি করেছে, অমুক কাজ করেছে ইত্যাদি কথা সবার কাছে বলে বেড়ানো।

শিশুরও কোমল একটা ব্যক্তিত্ববোধ আছে। আছে তার সম্মান, যা বিনষ্ট হলে সে আঘাত পায়। মনে কষ্ট পায় কিন্তু কাউকে তা বলতে পারে না। অনেক সময়ই অভিভাবক শাসনের ক্ষেত্রে ভুল করে ফেলে। তারা সন্তানদের ওপর কঠোরতা করে বসে এবং ধারণা করতে থাকে এর ফলে শিশু ভালো হয়ে যাবে। অথচ ফল হয় সম্পূর্ণ বিপরীত। বারবার অপমানিত হওয়া বা সম্মান হারানোর কারণে শিশুর মন থেকে সম্মান হারানোর ভয় চলে যায়। সে নির্লজ্জ হয়ে ওঠে। সঠিক পথ থেকে বিচ্যুত হয়ে পড়ে। মন্দ কাজ করা তার অভ্যাসে পরিণত হয়।

প্রহারের ক্ষতি: (চার) মিথ্যা শাস্তির ভয় তাকে বেপরোয়া করে তুলতে পারে

যে শাস্তি আপনি শিশুকে দেবেন না বা দিতে পারবেন না সে শাস্তির ভয় তাকে দেখাবেন না। এর ফলাফলও সুখকর হয় না।

সংশোধনের জন্য: (এক) তার পাশে থেকে স্নেহশীল অভিভাবকের আচরণ করুন

পক্ষান্তরে শিশু যখন তার পাশে স্নেহশীল একজন অভিভাবক পায়, সে তাকে ভুল করলে প্রজ্ঞা ও নম্রতার সাথে বুঝিয়ে বলবে, ভালো কাজের প্রতি তাকে আগ্রহী করে তুলবে তখন আর কঠোর আচরণের দরকার পড়ে না।

সংশোধনের জন্য: (দুই) একান্ত আলাপনে বুঝিয়ে বলুন

উদ্দেশ্য যদি সংশোধনই হয়ে থাকে তাহলে জেনে রাখুন, মারপিট করা সংশোধনের কার্যকার কোনো পন্থা নয়। একান্ত আলাপনে বুঝিয়ে বলার ফলাফল প্রকাশ্যে মারপিট করা থেকে হাজার গুনে উত্তম।

প্রহারের ক্ষেত্রে রাসুলুল্লাহ (স) এর আদর্শ

সুতরাং সেই মহান শিক্ষক থেকেই আমাদের সবকিছু শিখে নেওয়া কর্তব্য, যার ব্যাপারে আল্লাহ তাআলা বলেছেন: وإن تطيعوه تهتدوا- (আর যদি তাঁর অনুসরণ করো তাহলে হিদায়াত পেয়ে যাবে।) দলিল: সুরা আন নূর, ২৪ : ৫৪

আয়িশা রাদিয়াল্লাহু আনহা বলেন: ما ضرب رسول الله صلى الله عليه وسلم شيىٔا قط بيده ولا امراة ولاخادما الا ان يجاهد في سبيل الله- (জিহাদের ময়দান ছাড়া রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর হাত দিয়ে কখনো কোন বস্তুকে, নারীকে এবং খাদেমকে আঘাত করেননি।) দলিল: সহিহ আল মুসলিম, ফাযায়েল অধ্যায় : ৪২৬৯

সন্তান, খাদেম, স্ত্রীর ওপর রাগ না করে থাকা কেবল মহান কোনো ব্যক্তির পক্ষেই সম্ভব যার ধৈর্য অপরিসীম, সহনশীলতা আকাশছোঁয়া। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন: ليس الشديد بالصرعة انما الشديد الذي يملك نفسه عند الغضب(কুস্তিতে যে জিতে সে বীর নয়, বীর সেই ব্যক্তি ক্রোধের সময় যে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করে।) দলিল: সহিহ আল বুখারি, আদব অধ্যায় : ৫২৪৯

প্রহারের নীতিমালা: 

প্রহারের নীতিমালা: (০১) দশ বছরের চেয়ে কমবয়সী কাউকে প্রহার করা যাবে না

দশ বছরের চেয়ে কমবয়সী কাউকে প্রহার করা যাবে না। সালাতের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিধানের ক্ষেত্রে এই নিষেধাজ্ঞা ইসলাম জারি করেছে। তাহলে অন্যান্য ব্যাপারে বলাই বাহুল্য। সুতরাং দশ বছর বয়সে পা দেওয়ার আগে শিশুকে প্রহার করা উচিত নয়। তবে এতটুকু করা যেতে পারে, সালাতের জন্য যে পরিমাণ প্রহার করা হবে তার চেয়ে কম অর্থাৎ তিনটি আঘাত না করে একটি আঘাত করবে। কারণ, একেবারে ছেড়ে দিলে সে অবাধ স্বাধীনতা পেয়ে যাবে যা তার জন্য ক্ষতিকর কারণ হয়ে দাঁড়াবে।

প্রহারের নীতিমালা: (০২) যতটা কম প্রহার করা যায়

যতটা কম প্রহার করা যায়। খাবারের মাঝে লবণ যেমন, শাসনের ক্ষেত্রে প্রহারও তেমন হওয়া বাঞ্ছনীয়। লবনের পরিমাণ বেশি হলে খাবার যেমন বিষ্বাদ হয়ে যায়, ঠিক প্রহারের আধিক্য তার অন্তর থেকে ভয়-ডর ঝেড়ে ফেলে দেয়। ফলে বখে যাওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন: لا يوجد لدي فوق عشر جلدات الا في حد من حدود الله"আল্লাহ তাআলার নির্ধারিত হদ ছাড়া দশটার বেশি চাবুক (বেতের আঘাত) করা যাবে না।" দলিল: সহিহ আল বুখারি, হুদুদ অধ্যায়: ৬৩৪২, তিরমিযি, হুদুদ অধ্যায় : ১৩৮৩

প্রহারের নীতিমালা: (০৩)  তিনটার বেশি আঘাত নয় 

এখানে বোঝা দরকার, প্রাপ্তবয়স্কের ক্ষেত্রে হদ ছাড়া দশের বেশি চাবুক মারতে নিষেধ করা হয়েছে। সুতরাং এখনো যে বয়ঃপ্রাপ্ত হয়নি তার ব্যাপারে আপনার কী ধারণা! অবশ্যই তাকে দশটাও আঘাত করা যাবে না। উমর বিন আব্দুল আযিয রহিমাহুল্লাহ মুসলিমদের বিভিন্ন অঞ্চলে ফরমান লিখে পাঠান যে, (কোরআন শিক্ষাদানকারী) শিক্ষক একসাথে তিনটার বেশি আঘাত করতে পারবে না। তিনটি আঘাতই শিশুকে ভয় দেখানোর জন্য যথেষ্ট। দলিল: কিতাবুল ইয়াল লি ইবনু আবিদ্দুনিয়া : ১ / ৫৩১

বিখ্যাত কাযি শুরাইহ রহিমাহুল্লাহ বলেন, কোরআন শেখানোর ক্ষেত্রে শিশুকে তিনটির বেশি আঘাত করা যাবে না। কোরআনকে হৃদয়ঙ্গম করাতে জিবরাইল আলাইহিস সালাম রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে তিন বার চাপ দিয়েছিলেন।

প্রহারের নীতিমালা: (০৪)  শাস্তি নয় শিষ্টতার জন্য শাসন

আর হ্যাঁ, প্রহারকে এখানে আমরা বলব 'শিষ্টতা', শাস্তি নয়। অর্থাৎ নিছক শাস্তি হিসেবে আমরা প্রহার করব না; বরং প্রহারের মাঝে যখন শিশুর সংশোধন নিহত দেখতে পাব তখনই কেবল শিষ্টতা শেখাতে প্রহার করব।

প্রহারের নীতিমালা: (০৫)  শাস্তির তীব্রতা চামড়ার নিচে পৌঁছুবে না

তাফসির-বিশেষজ্ঞ ওলামায়ে কেরাম বলেন, প্রহারের ক্ষেত্রে লক্ষ্য রাখবে, বেতের আঘাত যেন বেশির চেয়ে বেশি চামড়া পর্যন্ত পৌঁছায়। গোশত পর্যন্ত যেন কোনোভাবেই গিয়ে না ঠেকে। যে আঘাত গোশতে পৌঁছুবে, চামড়া ফাটিয়ে দেবে তা হবে কোরআনের বিধানের লঙ্ঘন। কেননা, কোরআনের এই শব্দের [فاجلدوا] উদ্দেশ্য হলো মানুষের শরীরের চামড়ার বহিরাংশ। (অর্থাৎ, কৃত অপরাধের দরুন অবিবাহিত ব্যভিচারীর চামড়ায় এক শ'টি চাবুক মারা হবে) দলিল: মাহাসিনুত তা'বিল লিল কাসিম : ২৪৯

প্রাপ্তবয়স্কদের ক্ষেত্রে এই সংখ্যাটা (একশ) ধর্তব্য।

প্রহারের নীতিমালা: (০৬) বেত মোটা হওয়া যাবে না 

চাবুক (বেত) মোটা হওয়া যাবে না। সেখানে কোনো গিঁট থাকতে পারবে না। এ ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা এসেছে।
যায়দ বিন আসলাম রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের যুগে এক ব্যক্তি নিজের ব্যাপারে ব্যভিচারের স্বীকারোক্তি দেয়। রাসুল তার জন্য একটি বেত আনতে বলেন। একটি ভাঙ্গা বেত আনা হলো। তিনি বললেন, 'এটা ছাড়া?' আরেকটি নতুন বেত আনা হলো যেটি তখনো ছাড়ানো হয়নি। রাসূল বললেন, 'অন্যটা?' আরেকটি বেত নিয়ে আসা হলো যা মসৃণ করা ছিল। রাসূল সেটি দিয়ে আঘাত করতে আদেশ দিলেন। তাকে বেত্রাঘাত করা হলো। এরপর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন: ايها الناس   !قد ان لكم ان تنتهوا عن حدود الله، من اصاب من هذه القاذورات شيىٔا فليستتر بستر الله فانه من يبد لنا صفحته نقم عليه كتاب الله- (হে লোকসকল, এখন সময় হয়েছে আল্লাহ তাআলার সীমানা থেকে নিবৃত্ত হওয়ার। যে এসব নোংরামিতে লিপ্ত হবে সে যেন তা গোপন রাখে। আর যে আমাদেরকে তার খাতা দেখিয়ে দেবে তার ওপর আল্লাহ তায়ালার কিতাব কায়েম হবে (অর্থাৎ হদ কায়েম হবে)। দলিল: মুয়াত্তা মালিক, হদুদ অধ্যায় : ২১৯৯

প্রহারের নীতিমালা: (০৭) প্রহারকারী প্রহারের জন্য তার হাত বেশি ওপরে উঠাবে না।

প্রহারকারী প্রহারের জন্য তার হাত বেশি ওপরে উঠাবে না। 
উমর রাদিয়াল্লাহু আনহু এক প্রহারকারীকে বলেন,  তোমার বগল উঁচু করো না। দলিল: আত তামহিদ লি ইবনু আব্দইল বার : ৫ / ৩৩৪
এর দ্বারা উদ্দেশ্য হলো, আঘাতটা যেন সীমাতিরিক্ত প্রচন্ড না হয়।


এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

এই ওয়েবসাইটের নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url