ইমানের শাখা-প্রশাখা

ইমানের শাখা-প্রশাখা     

 

আমরা একটু চিন্তাভাবনা করলেই দেখতে পাই, যে কোন বিষয় বা বস্তুর মধ্যেই কয়েকটি বিশেষ বিশেষ অংশ রয়েছে। যার মধ্যে একটি হলো তার মূল বা প্রধান অংশ আর অপরগুলো হলো তার শাখা-প্রশাখা। যেমন- একটি বৃক্ষের কাণ্ড হলো তার মূল বা প্রধান অংশ আর অপরগুলো যেমন, লতা-পাতা, ডাল-পালা ইত্যাদি হলো তার শাখা-প্রশাখা। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, ইমানের মূল হলো কালেমায়ে তাইয়েবা لا اله الا الله محمد رسول الله এ বাক্যটির মর্ম মনেপ্রাণে বিশ্বাস করার নামই হলো ইমান। এটাই মুতাকাল্লিমীন-ইসলামী আকাইদ শাস্ত্রবিশারদগণ-এর অভিমত। তবে মুহাদ্দিসীন ও অধিকাংশ ইমামের মতে নিম্নোক্ত তিনটি বিষয়ের সমন্বয়ের নাম হলো ঈমান।


১. অন্তরের বিশ্বাস (تصديق بالجنان)

২. মুখের স্বীকারোক্তি (إقرار باللسان)

৩. ইসলামের রুকনসমূহ বাস্তবে পালন করা ألعمل) بالايمان)


হানাফী মাযহাবের ইমাম হযরত ইমাম আযম আবূ হানীফা (র)-এর মতে কেবল অন্তরের বিশ্বাস (التصديق بالجنان)-কেই ইমান বলা হয়। তিনি তাঁর এ অভিমতের সপক্ষে বিভিন্ন দলীল ও প্রমাণ উপস্থাপন করেছেন। যেমনঃ


ক. মহান আল্লাহর বাণী امنوا بالله -এ বাক্যের মর্মার্থই হলো, আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করা।


খ. ইমানের স্থান হলো ‘কালব’ (অন্তঃকরণ) যেমন, মহান আল্লাহ বলেনঃ

اُولَىِٔكَ كَتَبَ فِىْ قُلُوْبِهِمُ الْاِيْمَانَ

তাদের অন্তরে আল্লাহ সুদৃঢ় করেছেন ঈমান। দলিল: সূরা মুজাদালাহ-৫৮: ২২


অপর আয়াতে বর্ণিত হয়েছে,

 مِنَ الَّذِيْنَ قَالُوْۤا اٰمَنَّا بِاَفْوَاهِهِمْ وَلَمْ تُؤْمِنْ قُلُوْبُهُمْ ۚۛ 

–তারা মুখে বলে ঈমান এনেছি অথচ তাদের অন্তর ঈমান আনে না। দলিল: সূরা মা’ইদাহ-০৫: ৪১


এছাড়া আরো অনেক আকলী ও নকলী প্রমাণ দারা তার সপক্ষে দলীল উপস্থাপন করা হয়।


কিন্তু অধিকাংশ আম্বিয়ায়ে কিরামের মতে উপরে আলোচিত তিন প্রকার বিষয়ের সমষ্টিকে ঈমান বলা হয়। তাঁরাও বিভিন্ন আকলী ও নকলী দলীল দ্বারা মতের সপক্ষে প্রমাণ উপস্থাপন করেছেন। পূর্ব অধ্যায়ে এ বিষয়ে আলোচনা করা হয়েছে বিধায় এ স্থলে সংক্ষিপ্তভাবে আলোচনা করা হলো। মূলত এ অভিমতদ্বয়ের মধ্যে মৌলিক কোন বিরোধ নেই। কারণ হযরত ইমাম আ’যম আবূ হানীফা (র)-এর অভিমতটি হলো মূল ঈমান সম্পর্কে, আর অন্যদের অভিমতটি হলো কামিল (পূর্ণাঙ্গ) ঈমান সম্পর্কে।


আমাদের আলোচ্য বিষয় হলো, ঈমানের শাখা-প্রশাখা। তাই এর পক্ষে প্রথমে আমাদেরকে দেখতে হবে যে, ঈমানের শাখা-প্রশাখা আছে কি-না? পবিত্র কুরআন ও হাদীসে এ সম্পর্কে কী অভিমত ব্যক্ত করা হয়েছে। তারপর জানতে হবে যে, ঈমানের শাখা-প্রশাখা কয়টি ও কি কি? তাই এ প্রসঙ্গে নিম্নে বিশদ আলোচনা করা হলোঃ


কুরআন ও হাদীসের আলোকে ঈমানের শাখা-প্রশাখা


একথা অনস্বীকার্য যে, একজন ঈমানদার ব্যক্তিকে তার ব্যক্তিগত জীবন থেকে আরম্ভ করে সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় জীবনে শরী’আতের নির্ধারিত নিয়মানুযায়ী অনেক আচার-অনুষ্ঠান, ক্রিয়া কলাপ সমাধা করতে হয়। যাতে প্রকাশ পায় যে, ঈমানের অনেক শাখা-প্রশাখা রয়েছে। পবিত্র কুরআনের বিভিন্ন আয়াতে এবং প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর বিভিন্ন হাদীস দ্বারা প্রমাণিত যে, পূর্ণাঙ্গ বৃক্ষের মতো ঈমানের মূল বিষয়বস্তু ছাড়া তার রয়েছে অনেক শাখা-প্রশাখা। সহীহ বুখারী ও সহীহ মুসলিম শরীফের সংকলকগণ তাঁদের কিতাবে ঈমানের শাখা-প্রশাখা বর্ণনায় ভিন্ন ভিন্ন অধ্যায় সংযোজন করেছেন। যেমন বুখারী শরীফে রয়েছে, (باب أمور الايمان) ঈমানের বিষয়সমূহ। অনুরূপ মুসলিম শরীফে রয়েছে, (باب بيان عدد شعب الايمان) ঈমানের শাখা-প্রশাখার সংখ্যা এবং তার উচ্চতম নিন্মতম বিষয়ের বর্ণনা।



ঈমানের শাখা-প্রশাখার সংখ্যা


ঈমানের শাখা-প্রশাখার সুনির্দিষ্ট কোন সংখ্যার বর্ণনা নেই। তবে এ প্রসঙ্গে সহীহ মুসলিম শরীফে হযরত আবু হুরায়রা (রা.) হতে বর্ণিত হাদীসে রয়েছে যে,


الايمان بضع وسبعون أو بضع وستون شعبة-

–ঈমানের শাখা-প্রশাখার সংখ্যা সত্তর-এর কিছু অধিক অথবা ষাট-এর কিছু অধিক। হযরত সুহাইল থেকেও অনুরূপ হাদীস বর্ণিত আছে। তবে ষাটের অধিক না সত্তরের অধিক এ ব্যাপারে উভয় রাবীর বর্ণনায় সন্দেহ বিদ্যমান। কিন্তু ইমাম বুখারী (র) তাঁর কিতাবে بضع وستون (ষাটের অধিক) বলে বর্ণনা করেছেন। এ স্থলে প্রণিধানযোগ্য যে, ‘বিদউন’ শব্দের ব্যাখ্যায় ইমামগণের মধ্যে মতপার্থক্য রয়েছে। কেউ বলেছেন, بضع শব্দের দ্বারা তিন থেকে নয় পর্যন্ত, কেউ বলেন, তিন থেকে দশ পর্যন্ত। কেউ বলেন, দুই থেকে দশ পর্যন্ত যে কোন সংখ্যাকে বুঝায়। ইমাম খলীলের বর্ণনা মতে البضع السبع বিদউন হলো সাত। আর হাদীসের অপর শব্দ شعبة-এর অর্থ القطعة من الشىٔ যে কোন বস্তুর একটি অংশ। সুতরাং আলোচ্য হাদীসের অর্থ হবে بضع وسبعون او ستون ঈমানের ষাট অথবা সত্তর থেকে কিছু বেশি শাখা-প্রশাখা রয়েছে। ইমাম আবূ হাতীম ইবন হিব্বান (র) এর শাখাসমূহ তাঁর প্রণীত وصف الايمان وشعبه নামক কিতাবে উল্লেখ করেছেন। ইমাম আবূ হাতীম (র) আরো উল্লেখ করেছেন যে بضع وستون-এর রিওয়ায়েত যেমন সহীহ, তদ্রুপ بضع وسبعون-এর রিওয়ায়েতটিও সহীহ। কারণ আরবি পরিভাষায় কোন বিষয়ের আধিক্য বুঝাতে ‘বিদউন ওয়া সিত্তুন’ অথবা ‘বিদউন ওয়া সআবউন' ব্যবহৃত হয়।


আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত হাদীসে ঈমানের শাখা-প্রশাখাসমূহের মধ্যে সর্বোচ্চ শাখা হিসেবে لااله الا الله-এর উল্লেখ রয়েছে। এ দ্বারা বুঝা যায় যে, ঈমানের শাখাগুলোর মধ্যে এর মর্যাদা হলো সর্বোচ্চ। আর সর্বনিম্ন হলো اماتة الاذى عن الطريق অর্থাৎ কষ্টদায়ক বস্তু রাস্তা থেকে সরিয়ে দেওয়া। ঈমানের অন্যান্য শাখা এ দুই স্তরের মধ্যে রয়েছে। একদল হাদীসবিশারদ ঈমানের শাখা-প্রশাখা সম্পর্কে সবিস্তার বিভিন্ন পুস্তক রচনা করেছেন। যেমন আবূ আব্দুল্লাহ হালীমী (র) فواىٔد المنهاج ইমাম বায়হাকী (র) شعب الايمان শায়খ আব্দুল জলীল (র) النصاىٔح এবং ইমাম আবূ হাতেম (র) وصف الايمان وشعبه নামক গ্রন্থ প্রণয়ন করেছেন।




ঈমানের শাখাসমূহের বিস্তারিত আলোচনা


ঈমানের শাখাসমূহ তিন ভাগে বিভক্ত।

১. ঈমানের ঐ সকল শাখা যেগুলোর সম্পর্ক ই’তিকাদ ও অন্তরের আমলের সাথে।

২. ঐ সকল শাখা যেগুলোর সম্পর্ক মৌখিক স্বীকৃতির সাথে।

৩. ঐ সকল শাখা যেগুলোর সম্পর্ক দেহের বিভিন্ন অঙ্গপ্রত্যঙ্গের সাথে।

নিম্নে এ সম্পর্কে আলোচনা করা হলোঃ


প্রথম প্রকারঃ ই’তিকাদ ও অন্তরের আমলের সাথে সম্পৃক্ত ঈমানের শাখা-সংখ্যা হলো ৩০টি।


১. এক আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করা। তাঁর সত্তা (ذات) ও সকল সিফাতসহ (গুণাবলী) বিশ্বাস করা। আরো বিশ্বাস করতে হবে যে, তিনি এক ও অদ্বিতীয়, তাঁর কোন শরীক নেই, তাঁর সমকক্ষও কেউ নেই, তিনি চিরঞ্জীব ও চিরস্থায়ী।


২. মহান আল্লাহ একমাত্র স্রষ্টা, জগতের দৃশ্য-অদৃশ্য সব কিছুই তাঁর সৃষ্টি।


৩. ফেরেশতাদের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করা। ফেরেশতাগণ মহান আল্লাহর সৃষ্ট জীব। আল্লাহ তা'আলা ফেরেশতাগণকে বিশেষ বিশেষ দায়িত্বে নিয়োজিত রেখেছেন।


৪. সকল আসমানী কিতাবের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করা। যা আল্লাহ তা'আলার পক্ষ থেকে মানব জাতির হিদায়েতের জন্য নবী-রাসূলগণের প্রতি নাযিল করা হয়েছে।


৫. সকল নবীর প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করা। নবী-রাসূলগণ মহান আল্লাহর মনোনীত ও পছন্দনীয় ব্যক্তি। তাঁরা সকলেই সগীরা ও কবীরা সকল প্রকার গুনাহ থেকে পবিত্র ও নিষ্পাপ। নবুওয়াতের পরে তো নিষ্পাপ বটেই; নবুওয়াতের আগেও নিষ্পাপ।


৬. তাকদীরের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করা। অর্থাৎ তাকদীরের ভালমন্দ সব কিছুই আল্লাহর পক্ষ থেকে হয়।


৭. কিয়ামতের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করা। যার মধ্যে রয়েছে মৃত্যুর পর কবর থেকে আরম্ভ করে হিসাবনিকাশ পর্যন্ত সব কিছুর প্রতি বিশ্বাস রাখা। যেমন, কবরের মধ্যে ফেরেশতা কর্তৃক প্রশ্ন করা এবং তার জওয়াব প্রদান করা। কবরের আযাবকে বিশ্বাস করা। মৃত্যুর পর হাশরের ময়দানে উপস্থিত হওয়ার জন্য পুনরুত্থানের বিশ্বাস করা। ময়দানে হাশরে হিসাব প্রদানের জন্য বিশেষ এক সময় পর্যন্ত অবস্থান করা। সেখানে জাগতিক সকল আমলের হিসাব-নিকাশ প্রদানে বিশ্বাস রাখা; আমলকে ওযন দেওয়া, পুলসিরাত অতিক্রম করা ইত্যাদি সবকিছুই অন্তর্ভুক্ত।


৮. জান্নাতের প্রতি বিশ্বাস রাখা। এ প্রসঙ্গে আরো বিশ্বাস রাখতে হবে যে, জান্নাত হলো সর্বময় সুখ-শান্তিপূর্ণ স্থান। ঈমানদার বান্দাহগণ চিরস্থায়ীভাবে জান্নাতের মধ্যে সকল প্রকার নাজ ও নি’আমত ভোগ করে পরম সুখ-শান্তিতে থাকবেন।


৯. জাহান্নামের পথে বিশ্বাস রাখা। এর সাথে আরো বিশ্বাস রাখতে হবে যে, জাহান্নামের মধ্যে বিভিন্ন প্রকার কঠিন কঠিন শাস্তি রয়েছে, যা সকল বে-দ্বীন, মুশরিক ও কাফিরদেরকে চিরস্থায়ীরূপে ভোগ করতে হবে। মহান আল্লাহর নির্দেশ ব্যতিরেকে এক মুহূর্তের জন্যও কেউ নিস্তার লাভ করতে পারবে না। আর ঈমানদার বান্দাহদের মধ্যে যারা গুনাহগার তাদেরকে ক্ষমা করা না হলে তারা জাহান্নামের শাস্তি ভোগ করবে।


১০. মহান আল্লাহর সাথে মুহাব্বত রাখা। এর তাৎপর্য হলো, সন্তুষ্ট চিত্তে আল্লাহ তা'আলার সকল আদেশ-নিষেধকে মেনে নেওয়া এবং সে অনুসারে আমল করা। 


১১. মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর প্রতি মুহাব্বত রাখা। এর তাৎপর্য হলো, সর্বাবস্থায় তাঁর আদেশ-নিষেধ মেনে নেওয়া এবং তাঁর সুন্নাতসমূহ ও তরীকার অনুসরণ করে চলা। তাঁর সম্মান ও মর্যাদার প্রতি বিশেষ যত্নবান হওয়া এবং তাঁর তা’যীম করা। আর মুহাব্বতের সাথে তাঁর প্রতি দরূদ পাঠ করা ও সালাম পেশ করা এবং সকল প্রকার বিদ'আত বর্জন করা।


১২. মহান আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের উদ্দেশ্যে কারো সাথে মুহাব্বত রাখা অথবা কারো প্রতি ঘৃণা পোষণ করা। ঈমানদার বান্দাহদের সাথে বিশেষত সাহাবায়ে কিরাম, আহলে বায়ত, মুহাজিরীন, আনসার, আম্বিয়ায়ে দীন, আওলিয়ায়ে ‘ইযাম ও হাক্কানী উলামায়ে কিরাম-এর সাথে মুহাব্বত রাখা। আর যারা আল্লাহর নাফরমান ফাসিক বান্দাহ, বে-দ্বীন ও মুশরিক তাদের প্রতি অন্তরের সাথে ঘৃণা পোষণ করা।


১৩. ইখলাসের সাথে শরী’আত নির্দেশিত সকল আমল (কাজ-কর্ম) সমাধা করা। লোক দেখানোর উদ্দেশ্যে কোন আমল (কাজ-কর্ম) না করা। আর মুনাফিকী থেকে দূরে থাকা।


১৪. মহান প্রভুর দরবারে তাওবা করা, অর্থাৎ স্বীয় কৃত গুনাহের জন্য আল্লাহর কাছে নিজেকে লজ্জিত মনে করা এবং ভবিষ্যতে এরূপ অপরাধ থেকে নিজেকে বিরত রাখার অঙ্গীকার করা।


১৫. শরী’আত বর্জিত সকল কাজে অন্তরের সাথে মহান আল্লাহকে ভয় করা এবং তাঁর ক্রোধ ও শাস্তি থেকে দূরে থাকার চেষ্টা করা।


১৬. সকল কাজে মহান আল্লাহর রহমতের আশা পোষণ করা।


১৭. কোন বিষয়ে মহান আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ না হওয়া। অর্থাৎ এরূপ মনোভাব পোষণ না করা যে, আমি যে গুনাহ করেছি, মহান আল্লাহ হয়ত তা ক্ষমা করবেন না।


১৮. সর্বাবস্থায় আল্লাহর শোকরগুযারী করা।


১৯ ওয়াদা-অঙ্গীকার যথাযথভাবে পালন করা।


২০. সবর করা অর্থাৎ যে কোন বিপদে ধৈর্যধারণ করা।


২১. বিনয় প্রকাশ করা; যার মধ্যে  বড়দের প্রতি সম্মান প্রদর্শনও শামিল।


২২. স্নেহ-মমতা করা; যার মধ্যে  ছোটদের প্রতি স্নেহ ও মমত্ববোধ দেখানোও শামিল।


২৩. মহান আল্লাহ কর্তৃক নির্ধারিত সকল ভাল ও মন্দের উপর সন্তুষ্ট থাকা।


২৪. যে কোন কাজে মহান আল্লাহর উপর তাওয়াক্কুল করা ও ভরসা করা।


২৫. অহমিকা ও আত্মগরীমা ছেড়ে দিয়ে ইসলাহে নফস বা আত্মশুদ্ধির পথ অবলম্বন করা।


২৬. হিংসা-বিদ্বেষ না করা। যার মধ্যে হাসাদ, অপরের মন্দ কামনা বা পরশ্রীকাতরতাও শামিল।


২৭. লজ্জা-শরম বোধ করা।


২৮. অতিরিক্ত গোসা না করা। অর্থাৎ কোন কাজে-কর্মে এমনভাবে রাগান্বিত না হওয়া যাতে মানুষের হিতাহিত জ্ঞান লোপ পেয়ে যায়।


২৯. কাউকে কোন প্রকার ধোকা না দেওয়া বা কারো জন্য অমঙ্গল কামনা না করা।


৩০. দুনিয়ার মুহাব্বত অন্তর থেকে দূর করে দেওয়া। যার মধ্যে দুনিয়াবী ধান-সম্পদের লোভ এবং সম্মান ও মর্যাদার মোহও অন্তর্ভুক্ত। সুবিখ্যাত ফিকহ শাস্ত্রবিদ আল্লামা আইনী (র) বলেন, উল্লেখিত ধারাগুলোর মধ্যে অন্তরের সকল আমল অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। যদিও দৃশ্যত কোন কোন কাজ বাহ্যিক মনে হয়। কিন্তু একটু চিন্তা-ভাবনা করলেই বোঝা যাবে যে, তা অন্তরেরই আমল।


দ্বিতীয় প্রকারঃ মৌখিক স্বীকৃতির সাথে সম্পৃক্ত ঈমানের শাখাসমূহের সংখ্যা হল ০৭টিঃ


১. কালেমায়ে তায়্যিবা-মৌখিকভাবে পাঠ করা।


২. পবিত্র কুরআন তিলাওয়াত করা। 


৩. দীনী ইলম নিজে শিক্ষা করা। 


৪. দীনী ইলম অপরকে শিক্ষা দেওয়া।


৫. মহান আল্লাহর দরবারে দ’আ করা। 


৬. আল্লাহ তা'আলার যিকর করা।


৭. অনর্থক ও অপ্রয়োজনীয় কথা না বলা।




তৃতীয় প্রকারঃ দেহের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের সাথে সম্পৃক্ত ঈমানের শাখা-প্রশাখাসমূহের সংখ্যা হলো ৪০টি।

ঈমানের এই শাখাগুলো তিনভাগে বিভক্ত করা হয়েছে।


প্রথম ভাগ- যা বান্দার নিজের সত্তার সাথে সংশ্লিষ্ট; এরূপ আমল ১৬টি।


১. পবিত্রতা অর্জন করা, যার মধ্যে শারীরিক পবিত্রতা বলতে অযূ করা–গোসল করা। মহিলাদের হায়িয-নিফাস থেকে পবিত্রতা অর্জন করা বোঝানো হয়েছে। 


২. যথাযথভাবে নামায আদায় করা এবং তার পাবন্দি করা। ফরয, ওয়াজিব, সুন্নাত, মুস্তাহাব, নফল, কাযা সব নামাযই এর অন্তর্ভুক্ত। 


৩. দান-সাদাকা করা। যাকাত, ফিতরা, দান-সদাকা ইত্যাদি এর শামিল। এমনকি অপরকে কিছু বখশিস করা, মেহমানকে আহার করানো, মেহমানের সম্মান করা, গোলাম আযাদ করা ইত্যাদিও এর অন্তর্ভুক্ত। 


৪. রোযা পালন করা। ফরয, ওয়াজিব, এবং নফল সব রকমের রোযা এর অন্তর্ভুক্ত।


৫. হজ্জ আদায় করা। ওমরাও এর অন্তর্ভুক্ত। 


৬. ই’তিকাফ করা।


৭. দীনের হিফাযতের উদ্দেশ্যে হিজরত করা।


৮. যে কোন প্রকার মান্নত করলে তা পূরণ করা।


৯. কাফফারা আদায় করা। 


১০. কসম করলে তা পূরণ করা। 


১১. সতর ঢাকা। নামাযের মধ্যে কিংবা বাইরে পুরুষ-মহিলার উভয়ের জন্য শরী’আত নির্ধারিত সতর ঢেকে রাখা। 


১২. কুরবানী করা। 


১৩. মৃত ব্যক্তির গোসল, কাফন, জানাযা ও দাফনের ব্যবস্থা করা। 


১৪. ঋণ পরিশোধ করা। 


১৫. সকল প্রকারের লেন-দেন সঠিকভাবে করা এবং সুদের ক্রিয়াকলাপ থেকে বিরত থাকা।


১৬.সত্য সাক্ষ্য প্রদান করা এবং সে ক্ষেত্রে সত্য ঘটনা গোপন না করা।


দ্বিতীয় ভাগ- যা অপরের সাথে সংশ্লিষ্ট; এরূপ আমলের সংখ্যা ০৬টি


১. বিবাহ বন্ধনের মাধ্যমে যিনা ও ব্যভিচার থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে রাখা। 


২. সন্তানসন্ততির অধিকারের প্রতি সচেতন হওয়া এবং যথাযথভাবে তা আদায় করা। সাথে সাথে অধীনস্তদের অধিকারের প্রতিও যত্নবান থাকা। 


৩. পিতামাতার অধিকারের প্রতি সচেতন হওয়া। তাঁদের সাথে সর্বদা বিনয় ও নম্র ব্যবহার করা। তাঁদের কথা মান্য করা ইত্যাদি। 


৪. সন্তানসন্ততির সুশিক্ষা প্রদানের সুব্যবস্থা করা। শরী’আতের প্রয়োজনীয় ইলম শিক্ষা দেওয়া। 


৫. আত্মীয়-স্বজনের প্রতি সদাচরণ করা। তাদের অধিকারের প্রতি যত্নবান হওয়া। 


৬. বড়দের প্রতি সম্মান এবং ছোটদের প্রতি স্নেহ-মমতা প্রদর্শন করা।


তৃতীয় ভাগ- যা সর্বসাধারণের অধিকারের সাথে সংশ্লিষ্ট;  এরূপ আমল ১৮টি


১  ন্যায়বিচারের সাথে রাষ্ট্রীয় কার্য পরিচালনা করা। 


২. আহলুস সুন্নাত ওয়াল জামা’আতের মতাদর্শ অনুসরণ করা। 


৩. রাষ্ট্রপ্রধানের আনুগত্য (যদি তিনি শরী’আত বিরোধী কোন কাজের নির্দেশ না দেন) করা।


৪. পারস্পরিক ক্রিয়াকর্মে সৃষ্ট মতবিরোধের সঠিক ফায়সালা প্রদান করা। বিভ্রান্ত ও ফাসাদ সৃষ্টিকারীদের প্রতিরোধ করা। 


৫. ন্যায় ও ভাল কাজে পরস্পরে সাহায্য সহযোগিতা করা। 


৬. সৎকাজের আদেশ দেয়া ও অসৎকাজে নিষেধ করা। 


৭. আইন-শৃঙ্খলা বজায় রাখা।


৮. প্রয়োজনে জিহাদ করা। 


৯. যথানিয়মে আমানত আদায় করা। 


১০. অপরকে ঋণ প্রদান করা এবং যথাসময়ে ঋণ পরিশোধ করা। 


১১. প্রতিবেশীর হক আদায় করা এবং তাদের সর্বপ্রকার ক্ষতি করা থেকে বিরত থাকা। 


১২. পারস্পরিক লেনদেন, কথাবার্তা ও ক্রিয়াকর্ম ঠিকমতো ও নিষ্ঠার সাথে সম্পন্ন করা। 


১৩. অর্থ-সম্পদ যথাযথভাবে ব্যয় করা। অপব্যয় ও কৃপণতা থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে রাখা। 


১৪. পরস্পর সালাম-কালাম করা এবং কেউ সালাম করলে তার জওয়াব দেওয়া। 


১৫. হাঁচি প্রদানকারীর الحمد لله (আল-হামদুলিল্লাহ) বলার জওয়াবে يرحمك الله (ইয়ারহামুকাল্লাহ) বলা।


১৬. দুনিয়ার সকল জীবজন্তুর ক্ষতিসাধন করা থেকে বিরত থাকা।


১৭. শরী’আত-নিষিদ্ধ খেলাধুলা বর্জন করা। 


১৮. রাস্তায় অথবা চলার পথ থেকে কষ্টদায়ক বস্তু সরিয়ে দেয়া।


উপরে ঈমানের সর্বমোট ৭৭ (সাতাত্তর)-টি শাখার আলোচনা করা হলো। তবে কোন কোন মুহাদ্দিস হাদীসের উদ্ধৃতি দিয়ে ঈমানের শাখা আরও অধিক রয়েছে বলে উল্লেখ করেছেন। আবার উল্লেখিত ৭৭টি সংখ্যার মধ্যে একটি অপরটির সাথে সংযুক্ত করা যেতে পারে। সে ক্ষেত্রে ঈমানের শাখা উল্লেখিত সংখ্যা থেকেহ্রাস পেতে পারে। মূলত এর মধ্যে কোন বিরোধ নেই। কারণ উভয় প্রকার সংখ্যার উদ্দেশ্য হচ্ছে ঈমানের শাখা-প্রশাখার আধিক্য ব্যক্ত করা।

সূত্রঃ আইনী, শারহে বুখারী, ফতহুল বারী, শারহে মিশকাত।


এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

এই ওয়েবসাইটের নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url